গোলাম আজম খান, কক্সবাজার ::
মিয়ানমারের রাখাইনে ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হওয়া রোহিঙ্গারা এখন মুখোমুখি হচ্ছেন নতুন নতুন সমস্যার। যারা নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহী এবং স্বদেশে ফেরার জন্য রোহিঙ্গাদের মধ্যে নীরবে সচেতনতা সৃষ্টি করছেন তারাই গুমের শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ কোন্দলে রোহিঙ্গাদের মারামারি, ক্যাম্পে কর্তব্যরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও বিদেশী সাংবাদিকদের ওপর হামলাসহ নানা বিশৃঙ্খলায় অশান্ত হয়ে উঠছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংস ঘটনার পর থেকে প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাড়ে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফের ৩০টি আশ্রয়শিবিরে। নতুন পুরনো মিলিয়ে ওই ক্যাম্পগুলোতে এখন ১১ লাখ ১৮ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন।
সূত্র মতে, প্রতি ক্যাম্পে একজন করে হেড মাঝির অধীনে চার শতাধিক মাঝির মাধ্যমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা চলছে। ত্রাণতৎপরতাও চালানো হচ্ছে তাদের সহযোগিতায়। তবে বিশাল এই ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ মাঝি ও হেড মাঝিদের হাতে যেমন নেই, তেমনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও এখানে অসহায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রোহিঙ্গারা জানান, প্রত্যাবাসনবিরোধী তিনটি সন্ত্রাসী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো।
সূত্র জানায়, স্বদেশে ফিরে যেতে আগ্রহী টেকনাফের শামলাপুর রোহিঙ্গাশিবিরের বি-ব্লকের বি-ওয়ান বস্তির বাসিন্দা মাস্টার দিল মোহাম্মদকে গত ১২ মার্চ রাতে সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা তুলে নিয়ে গেছে। স্বদেশে ফেরার জন্য তিনি রোহিঙ্গাদের মধ্যে নীরবে সচেতনতা সৃষ্টি করছিলেন। স্বদেশে ফিরতে অনিচ্ছুক সশস্ত্র রোহিঙ্গা দল ওই রাতে স্ত্রী ও দুই সন্তানের মাঝ থেকে তাকে ধরে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে গেছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ নেই।
দুই সপ্তাহ আগে কুতুপালংশিবিরের লম্বাশিয়া এলাকায় গুম হয়ে যাওয়া হাফেজ শফিকুল ইসলামের (২৫) লাশ উদ্ধার করা হয়েছে শিবিরের একটি ল্যাট্রিনের গর্ত থেকে। ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে ১০ দিনের মাথায় অপহৃত একজন রোহিঙ্গা মাদরাসা শিক্ষকের লাশ উদ্ধার করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, শিবিরের প্রত্যাবাসনবিরোধী সশস্ত্র রোহিঙ্গা প্রকাশ্য দিবালোকে হাফেজ শফিককে অপহরণ করেছিল। কুতুপালং শিবিরের লম্বাশিয়া দারুসসালাম মাদরাসার শিক্ষক হাফেজ শফিক মাদরাসায় যাওয়ার পথে অপহৃত হন।
রওজিয়া বেগম নামে একজন রোহিঙ্গা নারী তার স্বামী মৌলভি আবুল হাশেমকে অপহরণের ঘটনা নিয়ে আদালতে মামলা করেন। আদালতের নির্দেশে উখিয়া থানার পুলিশ মামলাটি তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পাওয়ার কথা জানিয়েছে। অপর দিকে নুর কামাল নামে আরেক রোহিঙ্গার অপহরণ নিয়েও থানায় মামলা হয়েছে। দুই মামলার বাদিই এখন সন্ত্রাসীদের ভয়ে শিবিরের বাইরে অবস্থান করছেন।
উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গাক্যাম্প ঘুরে জানা গেছে, রোহিঙ্গারা অনেকেই রাখাইনে স্বেচ্ছায় ফিরতে আগ্রহী। অপর দিকে প্রত্যাবাসনবিরোধী সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা নিজেরা যেমনি দেশে ফিরতে চায় না তেমনি দেশে ফিরতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদেরও তারা বাধা দিচ্ছে।
সাধারণ রোহিঙ্গারা ভুলক্রমেও পুলিশ বা সেনাসদস্যদের ধারে কাছে যেতে চায় না। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর কোনো সদস্য দেখে ফেললে নিশ্চিত খুন বা গুম এমন ভয়েই তারা (সাধারণ রোহিঙ্গারা) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের এড়িয়ে চলেন। এমনকি বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটার পরও ক্ষতিগ্রস্ত বা নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিটি পুলিশ ফাঁড়ি বা ক্যাম্প ইনচার্জের কাছে বিচার চাইতে যেতে পারেন না। সশস্ত্র রোহিঙ্গা দল যখন যেটা চায় সেটাই তাদের কাছে সাধারণ রোহিঙ্গারা পৌঁছে দিতে বাধ্য।
রাশিদা নামে এক রোহিঙ্গা নারীর ১০ বছরের ছেলে মুহাম্মদ গুম হয়ে গেছে। রাখাইনে রাশিদার স্বামীকে মেরে ফেলার পর তিনি মিয়ানমার থেকে ছেলে এবং মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। আসার পরই ছেলে মোহাম্মদ নিখোঁজ হয়।
এ ছাড়া প্রত্যাবাসনবিরোধীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জঘন্যতম অভিযোগ উঠেছে, তারা সুন্দরী নারীদের ফ্রিস্টাইলে তুলে নিয়ে যায়। রাতের বেলায় মা-বাবা বা স্বামীর কাছ থেকে নিয়ে গিয়ে ভোরে আবার ফিরিয়ে দেয়। কেউ টুঁ শব্দটিও করতে পারে না।
রোহিঙ্গাশিবিরে অপহরণ-গুমের কথা স্বীকার করে শিবির তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তা (সিআইসি) মো: রেজাউল করিম বলেছেন, এ পর্যন্ত কমপক্ষে দুই শতাধিক ব্যক্তি অপহরণ-গুমের শিকার হয়েছে। তিনি এমনও বলেছেন, অপহরণ-গুমের চেয়ে ভয়াল ঘটনা ঘটছে রোহিঙ্গা নারীদের নিয়ে। প্রতি রাতেই সুন্দরী নারীদের তুলে নিয়ে যায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। যারা অভিযোগ দিচ্ছেন, তাদের ওপরও হামলে পড়ছে সন্ত্রাসীরা।
২১ ফেব্রুয়ারি কুতুপালং শিবিরের লম্বাশিয়া চৌরাস্তা এলাকায় জার্মান সরকারি টেলিভিশনের তিন সাংবাদিকসহ আট ব্যক্তি সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের হামলার শিকার হন।
রোহিঙ্গাশিবিরের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে মোড় নেয়ার কথা স্বীকার করেছেন উখিয়া থানার ওসি মো: আবুল খায়েরও। তিনি বলেন, ‘দেখুন, জার্মান টেলিভিশনের একটি সাংবাদিক দল রোহিঙ্গাদের মানবিক কাহিনী তুলে ধরতে একটানা সাত দিন ধরে কাজ করছিল। অথচ যাদের জন্য মানবিকতা দেখাতে সাংবাদিকরা বিদেশ থেকে এসেছেন, তাদের ওপর রোহিঙ্গারা অমানবিকতা দেখাতে একটুও পিছপা হয়নি।’ এ ঘটনায় চার শতাধিক সন্ত্রাসী রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ১১ রোহিঙ্গাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুতুপালংশিবিরের এক রোহিঙ্গা জানান, শুক্রবার জুমার নামাজের খুতবায় আরাকানি অনুবাদ দিতে গিয়ে তারা সন্ত্রাসীদের শত্রু হয়ে পড়ছেন। রোহিঙ্গা এই আলেম আরো জানান, সন্ত্রাসীরা রাখাইনে ফিরে যেতে চায় না। তারা শিবিরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়। অন্য দিকে শিক্ষিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় পেয়েই খুশি। রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি উন্নত হলে তারা ফিরে যেতে চায় বাপ-দাদার ভিটায়।
রোহিঙ্গাশিবিরে এমন গুম-অপহরণ আর খুনের তালিকা বেশ দীর্ঘ। সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের নির্মমতায় শত শত রোহিঙ্গার চোখের জলে ভাসছে পাহাড়ের রোহিঙ্গা শিবিরগুলো।
উখিয়ায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আন্দোলনের নেতা মাহমুদুল হক চৌধুরী জানান, রোহিঙ্গা শিবির নিয়ন্ত্রণ করছে কিছু সন্ত্রাসী গ্রুপ। তাদের নির্দেশ উপেক্ষা করে রোহিঙ্গা শিবিরে কেউ কিছু করতে পারে না। এখানে পুলিশও অসহায়। তিনি বলেন, যতই দিন যাচ্ছে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তারা স্থানীয় লোকজনের ওপর চড়াও হচ্ছে। ক্যাম্পে অপরাধ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত হলে স্থানীয়দের এখান থেকে পালিয়ে যেতে হবে।
উখিয়া থানার ওসি জানান, বিশাল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা পুলিশের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। এখানে অপরাধ প্রতিদিন বাড়ছে। ওসি বলেন, ‘রোহিঙ্গা নেতা আরিফসহ কয়েকটি হত্যা মামলা তদন্ত করতে গিয়ে আমরা যে তথ্য পাচ্ছি, তা খুবই উদ্বেগজনক। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’ তিনি বলেন, পুলিশ এখন রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়েই রাত-দিন ব্যস্ত। পুলিশ সদস্যদের কষ্টের সীমা নেই।
কক্সবাজার পুলিশ সুপার কার্যালয় সূত্র জানায়, বিপুল রোহিঙ্গা নিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও উদ্বিগ্ন। বিশাল ক্যাম্পে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রণে রাখা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষে কঠিন কাজ। তারপরও প্রায় এক হাজার পুলিশ সদস্য ঝুঁকি নিয়ে এখানে কাজ করে যাচ্ছেন। এখানে সাতটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ১৩টি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। রয়েছে পুলিশের ১২টি বিশেষ মোবাইল টিম।
কক্সবাজারে শরণার্থী, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মো: আবুল কালাম বলেন, ঝড়বৃষ্টি আর প্রচণ্ড গরমের মধ্যে পলিথিনের একটি শেডের নিচে বিপুল মানুষ এভাবে দীর্ঘদিন থাকতে পারে না। এই মুহূর্তে জরুরি তাদের নিরাপদে স্বদেশে ফেরত পাঠানো। মিয়ানমারের সদিচ্ছার অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে।
নয় দিগন্ত
পাঠকের মতামত: